“একদিন তুমিও ঠিক বুঝতে পারবে, ভালবাসলে সবাইকে অন্ধ হতে হয়”
থ্রি টাইমস তিন সময়ের তিনটে প্রেমের গল্প। যেখানে প্রেমের গল্পের ভেতর ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং তখনকার রাজনীতির অবস্থান ফুটে উঠেছে দারুণভাবে।
তাইওয়ানের কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার হৌ সিয়াও সিয়েন (Hou Hsiao Hsien) পরিচালিত ‘থ্রি টাইমস’ ২০০৫ সালে মুক্তি পায়। পুরো সিনেমাটিতে একই অভিনেতা অভিনেত্রী (Shu Qi & Chen Chang) দিয়ে তিন সময়ের (১৯৬৬, ১৯১১ ও ২০০৫) ভালবাসা ও প্রেমের বৈচিত্রতা তুলে ধরা হয়। যার মধ্যে তাইওয়ানের বিংশ শতাব্দীর এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের ঐতিহাসিক রূপ দেখা যায়।
A Time for Love তিনটে গল্পের মধ্যে প্রথম গল্প। যেখানে ১৯৬৬ সালকে তুলে ধরা হয়। চেন (Chen) সেনা সৈনিক পুল খেলতে এসে পুল হোস্টেজ মায়ার (May) প্রেমে পড়ে যায়। যদিও May-এর উচ্চারণটা ঠিক মায়া কিনা আমি নিশ্চিত নই, তবে আমার কাছে মায়াই যুতসই মনে হলো।
ক্যামেরার নাড়াচাড়াও যে অনেক কিছু বলতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ সিনেমাটির প্রথম দৃশ্য। Freeze-frame shot থেকে অভূতপূব এক Pan shot, তার সাথে জুড়ে দেয়া হয় প্ল্যাটার এর ১৯৫৯ সালের জনপ্রিয় একটি গান “Some Gets in Your Eyes.” অসাধরণ এই গানটি এই সিনেমাটিতে কয়েকবার ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সাথে আরো ছিলো তাইওয়ানের ঐতিহ্যবাহী একটি লোকগান। যার কয়েকটা লাইন ইংরেজিতে: “For three long years. Still I keep your warmth in my heart. And your voice in my ears. For three long years. The seabirds’ cry by the sea. So sad and melancholy.”
দ্বিতীয় গল্প A Time for Freedom সিনেমাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূণ অংশ। যা তাইওয়ানের ১৯১১ সালের প্রামাণ্য দলিল!
রিপাবলিকান কর্মী চেং (Chang) প্রায়ই পতিতালয়ে আসে। সেখানে তার এক গণিকার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। চেং-এর গণিকার বন্ধু আ মিই (Ah mei)। চেং এর রাজনৈতিক ভাবাদর্শে পৃথিবীর সংস্কার প্রয়োজন। আর তা শুরু হতে পারে আ মিই কে পতিতালয় থেকে মুক্তি দিয়ে।
নির্বাক সিনেমার মতন Inter-titles দিয়ে এই পুরো গল্পটি ধারণ করা হয়। দূর্দান্ত চিত্রধারণের সাথে অসাধারণ এক পিয়ানো সঙ্গীত ও তাইওয়ানের লোকজ একটি গানের সমন্বয়ে বৈচিত্র্যময় এক সঙ্গীত আবহ ছিল পুরো গল্পটায়। যেন সঙ্গীত নিজেই আস্ত একটা সিনেমা।
ইন্টার টাইটেলগুলোই মূলত দলিল। যেমন: “Ah Mei is pregnant by the heir out the Su family. He is ready to take as his concubine. What have they decided? The Su family offers 200 liang. But Madame asks for 300 so they couldn’t agree.” দেশ কেনাবেচার রেফারেন্স, যা সে সময়ের জাপান ও চীনকে তুলে ধরে।
আরো কিছু ইন্টার টাইটেল: “During my travels with Mr Liang, I met very important people. It has been very formative. Mr Liang says China will not be ready to help us free ourselves from Japan for another three decades.”
গণিকাকে দেওয়া চেং এর চিঠি হতে: “I reached Tokyo yesterday. I have already seen Mr Liang. We leave for Shanghai tomorrow. I saw the hall where they signed the treaty handing Taiwan over to Japan. Thinking of Mr Liang’s poem, I couldn’t help shedding a tear. Although this place has torn my heart, It is wrenching to leave it. Seventeen year have passed and the sorrowful waves still break on its shores.
তৃতীয় গল্প, A Time for Youth যা বর্তমান আধুনিক সময় এবং বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর ভালবাসাকে তুলে ধরে। জিং (Jing) ও জেনের (Zhen) সম্পর্ককে ঘিরেই মূলত গল্পটি। জিং একজন পপসঙ্গীত শিল্পী ও Biosexual, আর জেন একজন ফটোগ্রাফার।
এই গল্পটিতে কোন ধরনের তথাকথিত সিনেমার ন্যায় নির্দিষ্ট বক্তব্য (Message) নেই। এখানে কেবল সময়টাকেই তুলে ধরা হয়েছে। যে সময়ে এসে মানুষের আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রেমের অনুভূতি ও আবেগ বরাবর আগের মতই আছে। এই গল্পের গতি যেন নিজেই বর্তমান এই সময়কে তুলে ধরে। চিত্রধারণ আর সঙ্গীত বরাবরের ন্যায় অপূর্ব।
হৌ সিয়াও সিয়েন-এর এই পুরো চলচ্চিত্রটি যেন একটি ডুকুফিকশন। যদিও হৌ গতানুগতিক ডুকুমেন্টারির সিনেমা শৈলী অনুসরণ করেননি। তবে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালী ও জাপানের নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্রের ভাষার সাথে তার এই চলচ্চিত্রের ভাষার মিল পাওয়া যায় ব্যাপক। অবশ্য ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি চীন, হংকং ও তাইওয়ানের নিউ ওয়েভ সিনেমায় হৌ সিয়াও সিয়েন একজন অন্যতম পথিকৃৎ।
অতঃপর প্রেম ভালবাসা নিয়ে করা বহু সিনেমার তথাকথিত রূপ ভেঙেচুরে থ্রি টাইমস একটি অসাধারণ সিনেমা। শুধুমাত্র থ্রি টাইমস ’ই নয়! হৌ সিয়াও সিয়েন এর আরো অনেকগুলো অসাধারণ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিনেমা: The Boys from Fengkuei, A Summer at Grandpa’s, The Time to Live and the Time to Die, A City of Sadness, The Puppetmaster, Flowers of Shanghai, Millennium Mambo, Café Lumière, The Assassin.
চলচ্চিত্র পর্যালোচনাটি (Film Review) সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!