চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ – গ্রেইভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস (Grave of the Fireflies)

You are currently viewing চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ – গ্রেইভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস (Grave of the Fireflies)

 

Grave of the Fireflies Poster

জোনাকিদের কেন এতো তাড়াতাড়ি মরে যেতে হয়? আমার কাছে এর কোন যথার্থ উত্তর নেই। সেইটা (Seita)’র কাছেও এর উত্তর ছিল না।

হয়তো বা ছিল ডিলানের গানের কথায়,
“The answer, my friend, is blowin’ in the wind
The answer is blowin’ in the wind”

গ্রেইভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস (Grave of the Fireflies) একিইউকি নোসাকার (Akiyuki Nosaka) আত্মজৈবনিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয়া ইসাও তাকাহাতা (Isao Takahata) পরিচালিত সিনেমা। অ্যানিমেশন সিনেমা, তবে আমার কাছে শুধু অ্যানিমেশনের চেয়েও বেশি কিছু মনে হয়েছে। বলে রাখা ভালো, এটা কোন ফিকশন নয়, এটা সেই সময়ে সম্পূর্ণ বাস্তবতা। এই সিনেমার সেইটা (Seita) স্বয়ং এই উপন্যাসের লেখক একিইউকি নোসাকা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপান যখন আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করলো। রেলস্টেশনে কয়েকজন মানুষ জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। পরনে’ ছিঁড়ে জামা কাপড়, আর গড়ন দেখে ঠাহর করা যায় তারা খেতে পায়নি বহুদিন, মরে যায় যায় অবস্থা। স্টেশনের আশেপাশের তথাকথিত  সভ্য মানুষজন তাদের দেখে, আর বিরক্তি প্রকাশ করে। একজন মারা যায়, তার নাম সেইটা (Seita), বয়স, চৌদ্দ। তার একটি বোন আছে, সেটসুকো (Setsuko), বয়স, পাঁচ। মৃত সেইটা তাকে সাথে নিয়ে এখান থেকে ফিরে যায় তার ফেলে আসা সময়ে। সেইটার পরিপ্রেক্ষিত (Perspective) থেকেই পুরো সিনেমার গল্প।

About america

At the beginning of grave of the fireflies

চারদিকে আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ হতে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র, কামানের গোলা নিক্ষেপ হতে লাগলো। ঘরবাড়ি সব পুড়ে ছারকার। সেইটার মা মারাত্মক আহত হয়ে একসময় মারা যায়। সেইটা সেটসুকোকে মায়ের মৃত্যুর খবর জানায়নি। খাবার নেই, ওষুধ নেই, থাকার জায়গা নেই; যুদ্ধের সময় যা হয়ে থাকে সাধারণত। আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেয় এবং সেখানে সহ্য করে প্রতিনিয়ত নানা রকম বৈষম্য ও মানসিক অত্যাচার। এক পর্যায়ে, দুই ভাইবোন সেখান থেকে বের হয়ে  পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়।

Setsuko know that her mother is no more

সেটসুকো মৃত জোনাকিদের জন্য কবর খুঁড়তে থাকে আর তখন তার সহজ স্বীকারোক্তি, সে জানতো যে তার মা নেই। অপুষ্টি, অনাহারে ভুগতে ভুগতে, সেটসুকো একটা পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে যায়। দেখার কেউ নেই সবাই যে যার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। স্বার্থপর আচরণ প্রায়ই সর্বত্র, সময়টা যেহেতু যুদ্ধের। এদিকে ব্যাংকে টাকা থাকা সত্ত্বেও তারা অনাহারে দিন কাটায়! কেন? যুদ্ধের সময় অর্থের চেয়েও খাবার দামি। তাছাড়া সেইটা ভেবেছিল যুদ্ধ শেষ হলে সেগুলো কাজে লাগাবে। মনে রাখতে হবে, সেইটা’র বয়স তখন চৌদ্দ আর সময়টা তাকে তখন বারবার গুলিয়ে ফেলছিল। সেইটাকে কখনো কখনো স্বার্থপরমূলক আচরণ করতেও দেখা যায়। এমনকি প্রায়ই সময়, খাবার বেলায় সেইটা সিটসুকোর আগেই খাবার খেয়ে নিত।

Sometimes seita becomes selfish

অনাহারে থাকতে থাকতে শেষে উপায় না পেয়ে, সেইটা অন্যের চাষাবাদের জমিতে ফসল চুরি করতে গিয়ে সে জমির মালিকের কাছে ধরা পড়ে। সে জমির মালিক, তাকে ব্যাপক মারধর করে থানায় দিয়ে আসে। পুরো সিনেমায়, একমাত্র থানায় থাকা পুলিশটির মাঝেই একটু সহানুভূতি দেখা যায়।এদিকে সেটসুকো’র অবস্থার অবনতি হতে থাকে। আর তখনই সেইটা বুঝতে পারে যে ব্যাংকে রাখা সেভিংসগুলো তুলে সেটসুকোকে বাঁচাতে হবে। যথারীতি সে শহরে চলে যায় ব্যাংকের সেভিংসগুলো তুলতে। এদিকে সেটসুকো ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

The doll

পুরো সিনেমায় সেটসুকো’র মৃত্যু নিয়ে তেমন কোন twist নেই তবে আভাস ছিল অনেক আগ থেকে এবং এই আভাসটাই মূলত এই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হৃদয় বিদারক উপাদান। একটা পাঁচ বছর বয়সী শিশু ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি! এটা ভয়াবহ ব্যাপার, শিশুরা মরা যাচ্ছে আর ওদিকে মানুষ সীমানা, জাত, ধর্মকর্ম, ইত্যাদি নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে।

এই সিনেমাটি যুদ্ধ সময়কার মনুষ্য অবস্থার দলিল। স্টুডিও জিবলির (Studio Ghibli) ব্যানারে নির্মিত গ্রেইভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস পুরোটাই Traditional 2d Animation ফিল্ম। যার প্রত্যেকটা ফ্রেম হাতে আঁকা।

After the fireRain shot of grave of the fireflies

সিনেমাটির Mise-en-scène  প্রথম থেকেই কাব্যময়। একটা দৃশ্যে দেখা যায় বিষ্ফোরণ শেষে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি যেন শান্তি বয়ে আনে, এই সিনেমায় বৃষ্টির এইরকম আরও কয়েকটি দুর্দান্ত দৃশ্য রয়েছে। মন্তাজগুলোও বেশ! একটি দৃশ্যে দেখা যায়, মারা যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সেটসুকো হাতে তরমুজ নিয়ে তার ভাই সিটাকে ধন্যবাদ জানায়। এটি সেটসুকোর শেষ সংলাপ। এতেও কি বোঝা যায় না যে, শিশুরা কতটা নিষ্পাপ? এর পরপরই একটি মন্তাজ, সেইটা’র অনুপস্থিতে সেটসুকোর সময় কাটানোর কয়েকটা দৃশ্য যেখানে সিটসুকো হেসে খেলে বেড়াচ্ছে।

Last dialogue of Setsuko Setsuko playing around

এইরকম আরো কয়েকটি কাব্যিক দৃশ্য, যেমন: প্রথম দিকের একটিতে সেটসুকো মাটিতে বসে আছে মায়ের জন্য, আর সেইটা তাকে খুশি রাখার জন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাছাড়া জোনাকিদের দৃশ্যের মন্তাজটি কল্পনা শক্তির চূড়ান্ত প্রতিফলন। একের পর এক অসাধারণ সব কাব্যিক দৃশ্য। মাঝে মাঝে slow panning, কখনো বা একদম Freeze! সিনেমাটোগ্রাফি প্রতিটি ফ্রেমে ফ্রেমে নিঁখুত।

Beautiful shot

A wonderful montage

সিনেমার শব্দের কথা না বললেই নয়। শব্দের নীরবতার পরিপূর্ণ এক চিত্র পাই গ্রেইভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইস-এ। হঠাৎ করে নীরব হয়ে যাওয়া, দর্শক মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগাতে বাধ্য। আর Dubbing-এর কথা কেনই বা বাদ দিব, বিশেষ করে পাঁচ বছরের সেটসুকো’র কণ্ঠে ছিল এক অভূতপূর্ব আবেদন। সেটসুকো’র কণ্ঠ ছিল, আইয়ানো শিরাইশি (Ayano Shiraishi) নামক জাপানের এক শিশু অভিনেত্রী।

সিনেমা সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, মিচিউ মামিয়া (Michio Mamiya)। পুরো সিনেমায় সঙ্গীতে ছিল অসাধারণ ব্যঞ্জণা, যা অনুভূতিকে তীব্র আঘাত করে। পিয়ানোর শব্দ যেন অনুভূতিগুলোকে ডেকে নিয়ে যায় এক মর্মান্থিক নিমন্ত্রণে, আর বাঁশির জাপানি লোকজ সুর যেন এক অভেদ কল্পনার জগৎ তৈরি করে। সঙ্গীতের প্রত্যেকটি স্বরের সাথেই যেন ফ্রেমের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক। সিনেমার একেবারে শেষের সঙ্গীতটি (Soundtrack) মূলত সিনেমার প্রধান সঙ্গীত (Main Soundtrack)। যা সম্পূর্ণ একটি অডিও ভিজুয়াল মন্তাজ, যেখানে সুরে ভিন্ন জগৎ আর চিত্রে নতুন জাপান।

চলচ্চিত্রটি নিয়ে কতিপয় দুটি বিতর্কিত প্রশ্ন:

এটা কেন অস্কার পেল না?
এটি পুরোপুরি Anti American চলচ্চিত্র। এখানে সরাসারি সে সময়ের হিংস্র আমেরিকার অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবে Anti American চলচ্চিত্র অস্কার টস্কার পায় না। আর আমি যতদূর জানি, এই অস্কার নিয়ে ভালো পরিচালকগণ তেমন একটা মাথাও ঘামান না আজকাল। সম্প্রতি ইসাও তাকাহাতা পরিচালিত দ্য ট্যাল অব দ্য প্রিন্সেস কাঙ্গুয়া (The Tale of The Princess Kaguya) নামক আরেকটি মাস্টারপিস অস্কারে নমিশেন পেয়েছিল, ঐ ঐতদূরই! অস্কার আর পেল না। এবং তা নিয়ে ইসাও তাকাহাতারও বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।

দুই: এটি কী যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র?
এক হিসেবে এটি যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র বটে। তবে এটি যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র কিনা, এই ধরণের তর্ক আমার কাছে অহেতুক বাতুলতা বলে মনে হয়। কেননা, এই সিনেমাটি দেখার পর অনুভূতিপ্রবণ কোন মানুষ যুদ্ধ করতে চাইবে বলে আমার মনে হয় না। যদি কেউ চায় তবে সে সম্ভবত কোন মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে। কিংবা সে মানুষ নন, আপাতত গড়নে দেখতে মানুষের মতন কিন্তু ভেতরে সব সার্কিট-সেনসর বসানো; যাদের হুকুমের দাস কিংবা রোবটও বলা যেতে পারে।

এই সিনেমা দেখার পরে সাথে সাথে কিছু বলা বা লেখা আসলেই কষ্টকর। প্রথম যখন এই সিনেমাটি দেখি তখন কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম কিছু লেখার, কিন্তু পারিনি। এছাড়া পুরোপুরি এই সিনেমাটি আমি দেখেছি হাতে গোনা কয়েকবার। এর বাইরে এমনিতে টেনে টেনে দেখেছি, প্রিয় কোন দৃশ্য দেখার এবং প্রিয় কোন সংলাপ শোনার জন্য। এই সিনেমাটি পুরোটা বারবার দেখার জন্য সত্যিই সাহস প্রয়োজন অনেক।

অতঃপর গ্রেইভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইস একটি পরিপূর্ণ সিনেমা বা তার চেয়েও বেশি কিছু। যার প্রত্যেকটি ফ্রেমে ফ্রেমে রয়েছে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের মানুষের অবস্থা, ইরেজিতে যাকে বলে, Human Condition!

Setsuko of grave of the fireflies

চলচ্চিত্র বিশ্লেষণটি (Film Criticism) সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন